কানাডায় অভিবাসন বা পিআর স্ট্যাটাস প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে এসময়ে অনেকটা সোনার হরিণ হলেও, কিছু মানুষ কিন্তু অনেকটা না বুঝেই সেটি হারিয়ে ফেলেন বা হারানোর মুখোমুখি হন। কিভাবে? দুটো বাস্তব উদাহরণ দিয়ে সে বিষয়টি নিয়েই আজ লিখছি।
হায়দার সাহেব (ছদ্মনাম) বাংলাদেশে একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। কয়েকবছর আগে তিনি কানাডায় পড়াশোনা করতে এসে পরবর্তীতে সেদেশে স্থায়ী নাগরিক হিসেবে বসবাসের অনুমতিও পেয়েছিলেন। পিআর স্ট্যাটাস পাওয়ার কয়েকমাস পরেই ফিরে গেলেন দেশের সে বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার পদোন্নতি নাকি আসন্ন ছিল, যে কারণে তার পক্ষে পিআর হওয়ার পর একটানা দুইবছর কানাডায় অবস্থান সম্ভব হয়ে উঠেনি।
চলমান নিয়মানুযায়ী কানাডার পিআর স্ট্যাটাস পাওয়ার পর প্রতি পাঁচ বছরে কমপক্ষে দুই বছর কানাডায় সশরীরে অবস্থান করতে হয়, বা উপযুক্ত ক্ষেত্রে- বিদেশে কানাডার কোনও কোম্পানিতে অথবা কানাডা সরকারের স্বার্থে কাজ করতে হয়। আরও কিছু ছোটখাট ব্যতিক্রম আছে যার বিস্তারিত এ লেখায় অন্তর্ভুক্ত করতে চাই না।
এই যে পাঁচ বছর সময় তা যে কোনও উইন্ডো টাইম ফ্রেমে হতে হবে। তারমানে, ধরুন আপনি ২০১৫ সালের পয়লা জুন কানাডার পিআর স্ট্যাটাস পেলেন। সেক্ষেত্রে ২০২০ সালের পয়লা জুন পর্যন্ত সময়ে কানাডায় আপনার উপস্থিতিতে অন্তত দুই বছর হতে হবে। কেউ যদি এ পাঁচ বছর সময় গণনা অন্য কোনও তারিখ, যেমন- ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুলাই হতে ধরেন, সেক্ষেত্রে ২০২২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুলাই পর্যন্ত সময়ে তাকে কানাডায় দুই বছর অবস্থান করতে হবে, বা কানাডার স্বার্থে অন্য কোন দেশে অস্থায়ী পূর্ণকালীন কাজ করতে হবে। এর অর্থ দাঁড়ায়, পাঁচ বছরের সময়সীমাটি যে কোনও টাইম ফ্রেমে হতে পারে।
কানাডায় পিআর হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে কানাডা সরকার একটি কার্ড দিয়ে থাকে যার নাম পিআর কার্ড। এ কার্ডটির সাধারণত পাঁচ বছরের জন্য মেয়াদ থাকে। অনেকে মনে করেন, এ কার্ডটির যতদিন মেয়াদ থাকবে পিআর স্ট্যাটাসও ততোদিন ঠিক থাকবে, যা একটি ভুল ধারণা। পিআর স্ট্যাটাস ঠিক আছে কি নেই, তা হিসেবে করা হয় উপরে বর্ণিত ‘রেসিডেন্সি অব্লিগেশন’ বা কানাডায় বসবাসের বাধ্যবাধকতা থেকে। পিআর কার্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ হিসেবে নয়।
অনেক উচ্চশিক্ষিত মানুষও কানাডায় পিআর স্ট্যাটাস পেয়ে যাওয়ার পর তার রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে খুব সিরিয়াসলি ভাবেন না। বিষয়টা অনেকটা এরকম- কেউ একজন টানা দশবছর প্রেমের জীবনে প্রায় প্রতিবারই প্রেমিকার সাথে সাক্ষাতের সময় একটি ফুল নিয়ে গেছেন। অথচ, সেই প্রেমিকার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর তার জন্মদিনেই একটি ফুল দিতে ভুলে গেছেন।
এভাবে পরম কাঙ্ক্ষিত কিছু হাতের নাগালে পেয়ে গেলে তার যথাযথ মূল্য যারা দেন না, তাদের কপালে কিছু ভোগান্তি তো থাকেই। প্রফেসর হায়দার সাহেবের অবস্থাও হয়েছে সেরকম। দেশ থেকে তিনি একদিন কানাডায় ফিরলেন। তাড়াহুড়োর কারণে পোর্ট অব এন্ট্রিতে (বিমানবন্দরের বহির্গমন পথ) কর্মরত ইমিগ্রেশন অফিসার কেবল পিআর কার্ডের ভ্যালিডিটি দেখেই আর কোনও প্রশ্ন না করে প্রফেসর সাহেবকে কানাডায় প্রবেশ করতে দিলেন। অর্থাৎ, বিনা বাঁধায় তিনি কানাডায় ঢুকলেন। তাই ভাবলেন, সব ঠিক আছে, সমস্যা নেই।
কানাডায় প্রবেশের কয়েকমাস পরই পিআর কার্ড নবায়নের আবেদন করতে হলো তাকে। কারণ, পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। আবেদন দাখিলের কয়েক সপ্তাহ পর নবায়ন করা পিআর কার্ডের পরিবর্তে কানাডার ইমিগ্রেশন অফিস হতে তিনি পেলেন একটি চিঠি। ওই চিঠিতে লেখা আছে, তার পিআর রেসিডেন্সি অব্লিগেশন না মানার কথা। চিঠিতে হিসেব করে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে কিভাবে তিনি গত পাঁচ বছরে দুই বছর কানাডায় বসবাস করতে ব্যর্থ হয়েছেন সে বিষয়ে। চিঠির উপসংহারে বলা হয়েছে, তিনি অবিলম্বে কানাডা ত্যাগ করতে পারেন, বা আগ্রহী হলে এ আদেশের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আপিল করতে পারেন। সে সূত্রেই প্রফেসর সাহেবের সাথে আমার যোগাযোগ।
আরেকটি ঘটনা এক বয়স্ক ভদ্রমহিলার। তিনি পিআর স্ট্যাটাস পেয়ে যাওয়ার পর তার ছেলের সাথে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে বাস করতেন। আমাদের কোম্পানি এমএলজি ইমিগ্রেশন- এর অফিস কানাডার এডমন্টন শহরে। আমরা ভদ্রমহিলার এক নাতনিকে (ধরুন, তার নাম মিতা) কানাডার স্টাডি পারমিট বা স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে প্রফেশনাল সহায়তা দিচ্ছিলাম। একদিন মিতা কথায় কথায় জানালেন, কয়েকবছর আগে তার ঠাকুরমা (দাদি) কানাডার পিআর ছিলেন, এখন আর নেই। ‘মিতার দাদির পিআর স্ট্যাটাস আর নেই’ কথাটা শুনে ব্যাপারটা আরও বিস্তারিত জানার আগ্রহ জাগলো আমার মনে।
মিতাকে প্রশ্ন করলাম, ‘আপনার দাদি কি আমার সাথে তার পিআর স্ট্যাটাস নিয়ে কথা বলবেন?’
না স্যার কথা বলে লাভ নেই, ওটা চলে গেছে।’
তারপরও বলে দেখুন না, আমি যদি কোনভাবে হেল্প করতে পারি!
এর তিনচারদিনের মাথায় ভদ্রমহিলা আমাকে ফোন দিলেন। কিছুক্ষণের আলাপে জানলাম, বাংলাদেশে যাওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তিনি বাথরুমে পিছলে পড়ে পায়ে ভীষণ ব্যাথা পেয়েছিলেন। হাসপাতাল, ফিজিওথেরাপি ইত্যাদি করে খানিক সুস্থ হতে হতেই এলো করোনাভাইরাস। সব মিলিয়ে গত পাঁচ বছরে তিনি কানাডায় বসবাস করেছেন মাত্র পাঁচ মাস। তিনি জানেন, কানাডায় পাঁচ বছরে অন্তত দুই বছর না থাকলে পিআর স্ট্যাটাস থাকে না। তাই, স্ট্যাটাস চলে গেছে ভেবে তা নিয়ে আর খোঁজখবরও নেননি।
ভদ্রমহিলাকে আমি বললাম, ‘আপনি চাইলে আপনার বিষয়টা নিয়ে আমরা হেল্প করতে পারি।’
কিভাবে? ওটা তো নষ্ট হয়ে গেছে।
আমরা হিউমেনিটারিয়ান গ্রাউন্ডে আপনার জন্য আপিল করবো যদি আপনি আমাদের কোম্পানিকে নিয়োগ দেন। পিআর স্ট্যাটাস কখনো নিজে নিজে নষ্ট হয়না।
তাহলে কি আমি পিআর স্ট্যাটাস ফিরে পাবো?’
গ্যারান্টি দিতে পারবো না, তবে ভালো সম্ভাবনা আছে বলেই আপনাকে বলছি; না হয় বলতাম না।’
কথা সংক্ষেপ করি। তার কেইসটা আমরা নিয়েছি। টানা চারমাস কানাডার অভিবাসন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগের পর মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত পেতে আমরা সক্ষম হয়েছি। শেষতক কানাডা অভিবাসন অফিস, আইআরসিসি থেকে তাকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে ত্রিশ দিনের মধ্যে তার বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাঠাতে। তার মানে, নতুনভাবে ভিসা দেওয়া হচ্ছে তাকে। উপযুক্ত কারন থাকলে এভাবেই ‘হারিয়ে যাওয়া’ পিআর স্ট্যাটাসও ফিরে পাওয়া যায়। আপনার পরিচিত তেমন কেউ থাকলে আমাদের জানতে পারেন।
যাক, এ লেখা আর দীর্ঘ না করি। কানাডায় পড়াশোনা, বা অভিবাসন বিষয়ে কোনও বিশেষ প্রশ্ন থাকলে আমাকে নিচের ইমেইল ঠিকানায় জানাতে পারেন। পরের কোনও লেখায় আপনার আগ্রহের প্রতিফলন ঘটানোর প্রয়াস থাকবে।
তবে, বর্তমান পর্বসহ এ সিরিজের অন্য পর্বগুলোতে কানাডা ইমিগ্রেশন বিষয়ে যে সাধারণ আলোচনা করা হয়েছে, তা যেন কোনওভাবেই আইনি পরামর্শ হিসেবে বিবেচনা করা না হয়। কারণ, সুনির্দিষ্ট আইনি পরামর্শ দেওয়া হয় ব্যক্তিগত সাক্ষাতে, সাধারণ আলোচনায় নয়। মনে রাখবেন, প্রত্যেকের ইমিগ্রেশন কেইসই কোনও না কোনওভাবে আলাদা। তাই, একই ধরনের সমাধান সবক্ষেত্রে সুফল নাও বয়ে আনতে পারে।