জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক হিসাব খুলে রাষ্ট্রীয় সংস্থা সাধারণ বীমা করপোরেশনের (এসবিসি) আয় থেকে ২৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে একটি চক্র। চক্রটির নেতৃত্ব দিয়েছেন এ সংস্থারই প্রধান কার্যালয়ে অডিট অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স বিভাগের ব্যবস্থাপক আবুল কাশেম। ১০ বছর ৬ মাস ধরে এ কাণ্ড ঘটে চললেও এসবিসি ছিল পুরোপুরি অন্ধকারে।
এসবিসির উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) খসরু দস্তগীর আলমের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের কমিটির প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে। এতে বলা হয়, এসবিসির নামে বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকে ২০১০ সালে একটি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। হিসাবটিতে জমা হয় এযাবৎ ২৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এ
থেকেই ২৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা তুলেও নেওয়া হয়। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো), বাংলাদেশ শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিভিন্ন প্রকল্পের প্রিমিয়ামের টাকা এগুলো। এসবিসির সঙ্গে নৌবিমা করার অংশ হিসেবে প্রকল্পগুলো থেকে এ টাকা আসে। এসবিসির অনুমোদন ছাড়া অর্থ আত্মসাৎ ও পাচার করার উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগতভাবে ব্যাংক হিসাব খোলেন আবুল কাশেম। আবুল কাশেম এখন পলাতক।
২০০৯-১০ সময়ে আবুল কাশেম ছিলেন এসবিসির নিউমার্কেট শাখার ব্যবস্থাপক। নিউমার্কেটের আশপাশে অনেক ব্যাংক থাকলেও আবুল কাশেম হিসাব খোলেন কয়েক কিলোমিটার দূরে এক্সিম ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, হিসাব খুলতে আবুল কাশেম একটি মিথ্যা ও বানোয়াট পত্র এক্সিম ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখায় দাখিল করেন। এসবিসির ২০১০ সালের ২০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ৪৯২তম পর্ষদ সভায় এক্সিম ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখায় ‘চলতি হিসাব’ খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে তখনকার ব্যবস্থাপক মুসা আহমেদকে জানিয়েছিলেন আবুল কাশেম।
প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ব্যাংক হিসাব খুলতে গেলে কমপক্ষে দুজন স্বাক্ষরধারী থাকতে হয়। ফলে রফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তিকে এসবিসির প্রধান কার্যালয়ের কেন্দ্রীয় হিসাব বিভাগের ডিজিএম সাজিয়ে খোলা হয় ব্যাংক হিসাব। এসবিসি ব্যাংকে স্বল্প মেয়াদি আমানত হিসাব রাখে। আবুল কাশেম খোলেন চলতি হিসাব। প্রতিবেদনে বলা হয়, নিশ্চিতভাবেই পর্ষদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন আবুল কাশেম। কারণ, বাস্তবে শাখাটিতে হিসাব খোলার কোনো সিদ্ধান্ত পর্ষদ নেয়নি। রফিকুল ইসলাম নামের কোনো ব্যক্তিও এসবিসিতে ছিলেন না।
মুসা আহমেদ এখন পদোন্নতি পেয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের ঘাটতি না থাকায় আমাদের মনে সন্দেহ হয়নি।’ এর বাইরে কিছু বলতে চাননি তিনি।
যে প্রক্রিয়ায় টাকা আত্মসাৎ
নৌবিমা প্রিমিয়াম দিয়ে ১০ বছরে বিদ্যুৎ বিভাগ, বিসিএসআইআর এবং বুয়েটের জন্য শতাধিক প্রকল্পের আওতায় এসেছে বিভিন্ন ধরনের পণ্য। বিদেশের বন্দর থেকে জাহাজে করে বাংলাদেশের বন্দরে পণ্য আসার মাঝপথে ওই জাহাজ ডুবে গেলে আমদানিকারক যাতে ক্ষতিপূরণ পান, সে জন্য নৌবিমা করতে হয়। তবে জাহাজ পণ্য নিয়ে দেশে পৌঁছে গেলেই ওই বিমার আর কার্যকারিতা থাকে না। জাহাজ সচরাচর ডোবে না। আর এই সুযোগটি নিয়েছে আবুল কাশেমের নেতৃত্বাধীন জালিয়াত চক্রটি।
কেন তোলেননি জানতে চাইলে প্রথম আলোকে আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘চেক এলে আমরা দেখি যে প্রতিষ্ঠানের নাম ও স্বাক্ষর মিল আছে কি না। তা ছাড়া এই হিসাবের চেক সব সময় পাস হয়ে আসছে বলে সন্দেহ করিনি।’
টাকা গেছে কোথায় কোথায়
২০১০ সালের ১ এপ্রিল থেকে গত বছরের ৫ অক্টোবর পর্যন্ত ১০ বছর ছয় মাসের হিসাব বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রথম সাত বছরে অর্থাৎ ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১০ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। আর শেষের তিন বছরে নেওয়া হয়েছে ১৬ কোটি টাকার বেশি।
আবুল কাশেমের স্ত্রী নাসরিন আক্তার সুমী ট্রেডার্স নামক একটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী। এই প্রতিষ্ঠানের নামে হিসাব থাকা সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের উত্তরা শাখায় টাকা ঢুকেছে। বড় অঙ্কের টাকা স্থানান্তরিত হয়েছে উত্তরা আবাসন লিমিটেড এবং মিজানুর রহমান নামের এক ব্যক্তির হিসাবে।
এ ছাড়া এবি ব্যাংক ও ব্র্যাক ব্যাংকের কুমিল্লা, দি সিটি ব্যাংকের কাকরাইল, ব্যাংক এশিয়ার স্কশিয়া শাখা এবং এক্সিম ব্যাংকের এলিফ্যান্ট রোড ও মতিঝিল শাখায় আবুল কাশেমের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হিসাবে টাকা স্থানান্তরিত হয়েছে। এসবিসির মালিকানাধীন এসবিসি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে দেড় কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে আবুল কাশেমের।
উত্তরা আবাসন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোশারফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবুল কাশেমরা কয়েকজনে মিলে আমাদের প্লটে বিনিয়োগ করেছেন। অর্থের উৎস সম্পর্কে আমার জানা নেই।’
কুমিল্লার কোতোয়ালি থানার কৃষ্ণনগর গ্রামের অধিবাসী আবুল কাশেমের বর্তমান ঠিকানা ঢাকার উত্তরায়। উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরে ১৬ ও ১৪ নম্বর রোডে দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে তাঁর। আবুল কাশেমের মোবাইল ফোন বন্ধ, বক্তব্য জানতে ই-মেইল বার্তা পাঠালেও কোনো জবাব দেননি তিনি।
সরাসরি আবুল কাশেমের সঙ্গে কথা বলতে কয়েক দিন আগে ফ্ল্যাট দুটিতে যেতে চাইলে একটির দারোয়ান জহিরউদ্দিন বলেন, তিনি এখন বাসায় থাকেন না, থাকেন তাঁর স্ত্রী নাসরিন আক্তার। ইন্টারকমে কথা বলতে চাইলে দারোয়ান তাৎক্ষণিকভাবে নাসরিন আক্তারের সঙ্গে কথা বলেন। জহিরউদ্দিন বলেন, ‘ম্যাডাম বলেছেন তিনি অসুস্থ, তাই কথা বলবেন না।’
চক্রে আর কারা
প্রতিবেদনে উঠে না এলেও প্রথম আলো অনুসন্ধান করে দেখেছে, পুরো কাজটি একা করেননি আবুল কাশেম। ব্যাংক, বিদ্যুৎ বিভাগ, বিসিএসআইআর ও বুয়েটের কিছু কর্মচারী এর সঙ্গে যুক্ত। কীভাবে এই ঘটনা সম্ভব হলো, তা জানতে তিন প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারীর সঙ্গে কথা হয়েছে এ প্রতিবেদকের।
কোনো পণ্য আমদানি করতে গেলে এসবিসি প্রিমিয়াম, মূল্য সংযোজন করসহ সব খরচ ধরে বিল তৈরি করতে বলে বিউবোকে। এরপরই বিউবোর ক্রয় শাখা চিঠি দেয় অর্থ শাখায়। অর্থ শাখা তা পাঠায় বিমা শাখায়। বিমা শাখা থেকে হিসাব শাখা হয়ে চেক আসে আবার বিমা শাখায়। বিমা শাখাই চেক দেয় এসবিসিকে। এসবিসি তখন পলিসির দলিল দেয়, যার নাম কাভার নোট।
এসবিসির কর্মকর্তারা বলেছেন, এসবিসি চেক পেল কি না, সেই খোঁজ নিয়ে দেখেনি বিউবো। বেশির ভাগ চেক নিয়েছেন আবুল কাশেম নিজে। কখনো বিউবোর বিমা শাখা আবুল কাশেমকে চেক পৌঁছে দিয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, বিউবোর বিমা শাখার উপপরিচালক রইস উদ্দিন চেক তৈরি করে তাঁর অফিস সহকারী এ বি এম আশরাফুল হককে দিয়ে তড়িঘড়ি করে পাঠাতেন আবুল কাশেমের কাছে। বিউবো কার্যালয়ে রইস উদ্দিনের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, ‘আবুল কাশেম চেক দেওয়ার জন্য খুব তাড়াহুড়া করতেন। বলতেন পণ্য খালাস করা যাচ্ছে না।’ এ বি এম আশরাফুল হক বলেন, ‘আমি অফিসের আদেশ অনুযায়ী কাজ করেছি।’
কার্যালয়ে গেলেও ব্যস্ততার অজুহাতে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বিউবোর চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন। শুধু বলেন, ঘটনাটি তিনি জানেন। তবে কথা বলার সময় আসেনি।
বিউবোর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা অবশ্য বলেন, বিউবোর লোকেরা যেমন জড়িত থাকতে পারেন, এসবিসিরও অনেকের পক্ষে জড়িত থাকা বিচিত্র কিছু নয়।
এসবিসি এত দিন কী করেছে
এত বছর ধরে এই ঘটনা চলতে থাকলেও এসবিসির কাছে কেন ধরা পড়েনি, সে এক বিরাট রহস্য। সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ শাহরিয়ার আহসান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেহেতু এটা একটা ব্যক্তিগত জালিয়াতি, তাই এসবিসির পক্ষে তা বোঝার কোনো উপায় ছিল না। তবে ধরা পড়ার পর ব্যবস্থা নিতে আমরা দেরি করিনি।’
গত ২৮ নভেম্বর বিউবো, ৩ ডিসেম্বর বিসিএসআইআর ও বুয়েটকে চিঠি দিয়ে প্রিমিয়াম বিল, পলিসি, কাভার নোট, মানি রসিদ ইত্যাদি চেয়েছে এসবিসি। বিসিএসআইআরের চেয়ারম্যান মো. আফতাব আলী শেখ প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুরো ঘটনাটিই অবিশ্বাস্য।’
এদিকে এক্সিম ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখায় হিসাব খোলার ফরম বিশ্লেষণে দেখা যায়, আবুল কাশেমের সঙ্গে যৌথ স্বাক্ষরধারী ব্যক্তির নাম মো. রফিকুল ইসলাম, তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর (এনআইডি) ২৬৯৯৫০৩৫১৭৯৩২। পেশা ‘সার্ভিস’, পদ ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার।
এসবিসির তদন্ত দল ধারণা করছে, কারও কোনো একটা ছবি ব্যবহার করে আবুল কাশেম নিজেই তাঁর নাম দিয়েছেন রফিকুল ইসলাম। বাস্তবে এই ছবির ব্যক্তিটি কে, তা তাদের কাছে অজানা। নির্বাচন কমিশনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উল্লিখিত এনআইডি ভুয়া।
পুরো ঘটনা শুনিয়ে মতামত চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটা বিস্ময়কর ঘটনা শুনলাম। আবুল কাশেম হোতা হতে পারেন, তবে এসবিসি, ব্যাংক, বিউবোসহ তিন সংস্থায় চক্রের অন্য সদস্যরা যে আছে, তা সহজেই অনুমান করা যায়।’ আবুল কাশেমের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের পাশাপাশি তদন্ত করে জড়িত অন্যদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন ইফতেখারুজ্জামান।