বিএনপির প্রধান অভিভাবক ডা. জাফরুল্লাহ তার দলকে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলনে নামার জোর পরামর্শ দিয়েছেন। বিএনপি যে এত দিন আন্দোলনে নামেনি এর কারণ দর্শাতে গিয়ে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপিকে এলএসডি (এক প্রকার নেশার ওষুধ) খাইয়ে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে।’ ডা. জাফরুল্লাহর এই উক্তি শুনে মনে হয় আওয়ামী লীগ এখন নিজেই এলএসডি খেয়ে ঘুমিয়ে আছে। প্রতিটি জাতীয় সংকটে সরকারকেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায়। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কোনো ভূমিকা দেখা যায় না। ডা. জাফরুল্লাহ যদি তার উপদেশটি আওয়ামী লীগকেও দিতেন, তাহলে ভালো করতেন।
বিএনপি আন্দোলন করার দল নয়, সন্ত্রাস করার দল। আওয়ামী লীগ জন্ম অবধি আন্দোলন করে আসছে। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার যুদ্ধ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ভূমিকা গৌরবোজ্জ্বল। তারপর জিয়া-এরশাদের স্বৈরাচারী শাসন উচ্ছেদের ব্যাপারেও আওয়ামী লীগের ভূমিকা ছিল লড়াকু। শেখ হাসিনার ভূমিকা ছিল জোয়ান অব আর্কের। তার পর ২০০৮ সালে ক্ষমতায় যেতেই কী হলো? কী নেশার দ্রব্য খেয়ে আওয়ামী লীগ ঘুমিয়ে পড়ল! ঠিক আসহাবে কাহহাফের মতো। যিনি এখনো তার কুকুরটি সঙ্গে নিয়ে ঘুমোচ্ছেন। জাগবেন নাকি রোজ কিয়ামতের ঠিক আগে। আওয়ামী লীগও তেমনি ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে সঙ্গে নিয়ে ঘুমুচ্ছে। কবে জাগবে ঠিক নেই। তাদের এলএসডি খাওয়ানোর দরকার হয়নি, তিন দফা একাধিক্রমে ক্ষমতায় থাকাই তাদের জন্য এলএসডির কাজ করেছে।
বিএনপির সামনে না হয় আন্দোলন করার ইস্যু নেই। গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করবে? জনগণ জানে বিএনপি তাদের কী গণতন্ত্র উপহার দিয়েছিল। খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে আন্দোলন করবে? খালেদা জিয়া কোনো রাজনৈতিক বন্দি নন। তিনি অর্থ ঘটিত দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত আসামি। এই ধরনের দণ্ডিত কয়েদিদের মুক্ত করার ব্যাপারে সহজে নিজের দেশ এবং বহির্বিশ্বের মানুষের সমর্থন পাওয়া যায় না। বিএনপি বারবার চেষ্টা করেও খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে জনসমর্থন গড়ে তুলতে পারেনি।
কিন্তু আওয়ামী লীগের সামনে আন্দোলনে নামার বহু রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইস্যু আছে। এই ইস্যুগুলোর যে কোনোটি নিয়ে আওয়ামী লীগ সক্রিয় হতে পারত। দুর্নীতি দমন, দল শুদ্ধীকরণ, সামাজিক অবক্ষয় রোধ—এই প্রতিটি ইস্যুতে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী দলগুলোর সক্রিয় হওয়া উচিত ছিল। যখন হেফাজতি দুষ্কৃতিরা জাতির পিতার ভাস্কর্যে হাত দিয়েছে তখন তো আওয়ামী লীগের বিশেষ করে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের গর্জে ওঠা উচিত ছিল। আওয়ামী লীগ মাঠে থাকলে সেখানে জামায়াত বা হেফাজতি কারো মাঠে নামার সাহস হতে পারে?
কিন্তু আওয়ামী লীগ মাঠে নেই। তারা সব সমস্যার সমাধানের ভার সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়ে রাজনীতির পরিবর্তে তেজারতিতে ব্যস্ত। রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতিতে কেবল সরকারের ওপর সব সমস্যার সমাধানের ভার ছেড়ে দিলে আমলাদের শক্তি বাড়ে। বাংলাদেশে এখন তাই হয়েছে। সরকার ক্রমশ আমলানির্ভর হয়ে পড়ছে। আমলারা কখনো জনকল্যাণের নীতি নির্ধারণ করতে পারেন না। বাংলাদেশের আমলারাও তা পারেননি। দেশে তাই হু হু করে দুর্নীতি বাড়ছে, ক্ষমতার অপব্যবহার বাড়ছে। শেখ হাসিনা রাতদিন খেটে দেশের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু-কথিত ‘চাটার দল’ তা খেয়ে ফেলছে।
আওয়ামী লীগ নিষ্ক্রিয়। স্বাভাবিকভাবেই আমলারা সক্রিয়। ‘এটা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ’, ‘ওটা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ’—এই অজুহাত দেখিয়ে আমলারা যা খুশি তা করছেন। তাদের ওপর অধিকাংশ মন্ত্রীর কোনো কর্তৃত্ব নেই। আমি তো এক মন্ত্রীর কথা জানি, যিনি অফিসে বসে তার সচিবকে ডাকলে সচিব জবাব দিতেন, আমি পিএসের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপে ব্যস্ত আছি। এখন আসতে পারব না। এখনকার মন্ত্রী, উপমন্ত্রীদের অধিকাংশই কোনো দিন মন্ত্রী হওয়ার আশা স্বপ্নেও দেখেননি। সে যোগ্যতা ও সাহসও তাদের নেই। তবু তারা মন্ত্রী হয়েছেন। আমলাদের কোনো নির্দেশ দেওয়ার সাহস তাদের নেই, যোগ্যতাও তাদের নেই। তাদের অনেকেই কোনো কাজের জন্য অনুরোধ জানালে বলেন, দেখি প্রধানমন্ত্রী কী বলেন। অর্থাত্ সব ক্ষমতা এবং সব দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর। তাহলে তারা আছেন কেন?
এই ধরনের একটি মন্ত্রিসভা দ্বারা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ চলে না। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধির ধারণা দেশের এই সংকট মুহূর্তে মহাজোটের সব মন্ত্রীকে বাদ দিয়ে কেবল আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভা গঠন ঠিক হয়নি। এখন প্রধানমন্ত্রীর পাশে হোসেন তওফিক ইমামের মতো রাজনৈতিক উপদেষ্টাও নেই। বর্তমানে করোনা সমস্যার মোকাবিলাসহ সরকারের বহু কাজেই অব্যবস্থার অভিযোগ উঠছে। প্রধানমন্ত্রীর পাশে অভিজ্ঞ মন্ত্রী থাকলে এ অবস্থা হতো না। এক-এগারোর সময় সংস্কারপন্থি হয়েছিলেন এই অভিযোগের দায় এখনো যারা বহন করছেন, প্রধানমন্ত্রী একবার তাদের ক্ষমা করে মন্ত্রিসভায় গ্রহণ করেছিলেন। এবার তাদের মধ্যে সবচাইতে অভিজ্ঞ নেতাকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ রাখায় তার অভিজ্ঞতা ও সেবা থেকে সরকার এবং দেশ বঞ্চিত হয়েছে।
ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন শেখ হাসিনার আগের মন্ত্রিসভায় থাকায় সরকারের একটা সেন্ট্রাল লেফট চরিত্র ছিল। তাকে বাদ দেওয়ায় গোটা মন্ত্রিসভা কট্টর দক্ষিণপন্থি চেহারা ও চরিত্র ধারণ করেছে। কৃষ্ণ মেননকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়ে নেহেরু এই ভুলটা করেছিলেন। পরে তিনি কৃষ্ণ মেননকে তাড়াতাড়ি আবার মন্ত্রী করে নিজের ভুলটা শুধরে ছিলেন। বাজারে গুজব ট্রাম্প এডমিনিস্ট্রেশনের গোপন চাপে প্রধানমন্ত্রী বাম রাজনীতিকদের তার মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়েছিলেন। আমি এই গুজবে বিশ্বাস করি না। বিশ্বব্যাংকের আরো গুরুতর চাপের মুখে যে হাসিনা মাথা নোয়াননি, তিনি ট্রাম্পের রক্তচক্ষুকে ভয় করেছিলেন তা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদ একসময় এই পদে ছিলেন। বর্তমানে ওবায়দুল কাদের এই পদে আছেন। আগের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে তার কোনো তুলনা করি না। কিন্তু তিনি একজন সাহসী ও উপযুক্ত সাধারণ সম্পাদক। সহসা দুরারোগ্য ব্যাধি হওয়ায় শারীরিকভাবে তিনি আগের মতো দলের কাজে সক্ষম ছিলেন না। শেখ হাসিনাও ব্যাপারটা বুঝে তার ওপর তেমন চাপ দেননি। বর্তমানে ওবায়দুল কাদের সুস্থ হয়ে দলীয় কাজে মন দিতেই দলের ভেতর থেকেই একটি উপদল তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত পাকাচ্ছে মনে হয়।
ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে তার ছোট ভাই মির্জা কাদেরের আকস্মিক বিদ্রোহ, ভাই এবং দলের বিরুদ্ধে কুত্সা রটানোর পেছনে বাইরের চক্রান্তকারী থাকতে পারে। কিন্তু দলের ভেতরের চক্রান্তকারী বেশি মনে হয়। কাদের মির্জা যা করছেন, তাতে তাকে বহুদিন আগে দল থেকে বহিষ্কার করা উচিত ছিল। তিনি কাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে এখনো দলে অবস্থান করছেন—সেটাই প্রশ্ন।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডা. জাফরুল্লাহ একজন প্রবীণ মানুষ। তার উচিত দলনিরপেক্ষ হওয়া এবং মেপে কথা বলা। জ্ঞানী পুরুষরা তাই করেন। জাফরুল্লাহ অনেক সময় আবোলতাবোল বকেন। এটা বার্ধক্যজনিত কারণে করেন কি না জানি না। আমাদের রাজনীতিতে একজন দলনিরপেক্ষ অভিভাবক দরকার। যিনি সব দলকে তাদের ভুলভ্রান্তি দেখাবেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশপ টুটু এই দায়িত্বটা পালন করেছেন। বাংলাদেশে এমন একজন বিশপ টুটু আমরা পাইনি। জাফরুল্লাহ কি বিএনপির অভিভাবকত্ব ছেড়ে এই দায়িত্বটা নিতে পারেন না? বিএনপি এলএসডি খেয়েছে বলে তিনি যে কথাটি বলেছেন আসলে সেই এলএসডি খেয়েছে আওয়ামী লীগ। এই এলএসডি হচ্ছে তিন দফা একটানা ক্ষমতায় থাকার অহমিকা। ডা. জাফরুল্লাহর উচিত ছিল এই উপদেশটা আওয়ামী লীগকে দেওয়া।