‘সরকারি কোনো সাহায্য তো আমরা পাই নাই। আগের কাম নাই দেইখ্যা মাস্ক বেচি,’ এভাবেই নিজের বর্তমান অবস্থা জানালেন সাবেক রেস্তোঁরাকর্মী শহীদুল ইসলাম। তার মতোই কাজ হারিয়ে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন প্রায় পাঁচ লাখ রেস্তোঁরা-সুইটমিট শ্রমিক।
বাংলাদেশে অবকাঠামো নির্মাণ, পরিবহন, রেস্তোঁরা ও আবাসিক হোটেল খাতে কাজ করেন প্রায় এক কোটি ৫২ লাখ শ্রমিক। করোনা সংকটে এরা কারো আলোচনায় নেই, সহায়তা বা প্রণোদনাও পাননি বললেই চলে। বর্তমান লকডাউনে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
বাংলাদেশ রেস্তোঁরা-সুইটমিট শ্রমিক ফেডারেশন, ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশ, সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন এবং বাংলাদেশ হোটেল এন্ড ট্যুরিজম ওয়ার্কার্স ফেডারেশন থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেশে মোট রেস্তোঁরাকর্মী আছেন অন্তত ২৫ লাখ, নির্মাণ শ্রমিক আনুমানিক ৪০ লাখ, পরিবহন খাতে ৭০ লাখ ও ট্যুরিজমে আছেন অন্তত ১৭ লাখ।
সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, করোনা সংকটে সবচেয়ে বেশি পেশা পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে রেস্তোঁরা খাতে, অন্তত ২০ শতাংশ শ্রমিক কাজ হারিয়ে অন্য পেশায় গেছেন। এদের সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ।
বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় আনুমানিক বারো লাখ নির্মাণ শ্রমিকের মধ্যে কাজের অভাবে বসে আছেন অন্তত ৫০ শতাংশ। এদের কিছু অংশ কাজের সন্ধানে মৌসুমি শ্রমিক হিসেবে অন্য খাতে গেছেন। বাকি অর্ধেক বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কাজ পেয়েছেন। তবে পরিবহন এবং ট্যুরিজম খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পেশা পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর।
খাতগুলোতে পর্যাপ্ত সরকারি-বেসরকারি সহায়তা না আসার প্রসঙ্গও সামনে তুলে ধরেছেন শ্রমিকনেতারা। জানা গেছে, স্বতন্ত্র শ্রম খাত হিসেবে এখনো স্বীকৃতি পায়নি আবাসিক হোটেল ও পর্যটন। নির্মাণ শ্রমিকরা কিছু বেসরকারি সহায়তা পেলেও তা ভীষণ অপ্রতুল। রেস্তোরাঁ শ্রমিকরা বলার মতো কিছুই পাননি।
অন্যদিকে পরিবহন শ্রমিকরা ফেডারেশনের তরফ থেকে এবছর লকডাউনের শুরু থেকেই আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালগুলোতে একবেলা করে খাবার পেয়েছেন। একবার চাল, তেল, আলু ও পেঁয়াজের ত্রাণও পেয়েছেন তারা। ঈদের আগে ঈদ উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন পরিবহন শ্রমিক নেতারা। উপহারে থাকবে পোলাওয়ের চাল, চিনি ও সেমাই। তবে এসব সহায়তার পরিমাণ চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়।
সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান বলেছেন, এই সহায়তা বাস্তব প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। করোনার চেয়ে বড় জ্বালা হয়েছে পেটের জ্বালা। একজন শ্রমিককে নাহয় খাওয়ালাম টার্মিনালে কিন্তু তার পরিবারের কী হবে?
তিনি আরো বলেন, সিএনজি চলে, অটো চলে, আবার ঢাকা থেকে বিভিন্ন জেলায় মাইক্রোবাসও চলছে। বলা যায় সবই চলে। এগুলো যখন পরিবহন শ্রমিকরা দেখে তখন তারা বলে, কিছু চলবে আর কিছু চলবে না- তা তো লকডাউন হতে পারে না। লকডাউন হলে সবার লকডাউন দেন, আমরা কষ্ট করে যেভাবে পারি চলি। কেউ খাবে আর কেউ খাবে না, তা হবে না।
ওসমান আলী আক্ষেপ করে মন্তব্য করেন, গার্মেন্টস-কাঁচাবাজার-কারখানা খোলা তাহলে পরিবহনের সাথে কিসের শত্রুতা!
পরিবহন, নির্মাণ, রেস্তোরাঁ ও ট্যুরিজম খাতের শ্রমিকদের নিয়ে আলোচনা না হওয়ার প্রসঙ্গে সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী ও বর্তমান সাংসদ মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, এই শ্রমিকরা আসলেই সহায়তা পায়নি। তারা সোশাল সিকিউরিটি নেটওয়ার্কে নেই, এরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। সরকারের উচিত এই শ্রমিকদের তালিকা তৈরি করে এরা যাতে দু’মাস বা তিনমাস চলতে পারে এমন আর্থিক সাহায্য করা উচিত।
বাংলাদেশ রেস্তোঁরা-সুইটমিট শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বলেন, শ্রমিকদের প্রতি রাষ্ট্র ও রেস্তোরাঁ মালিকদের ন্যূনতম যে দায়িত্ব তা তারা পালন করেনি। করোনায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার পর থেকে শ্রমিকদের ফোনই ধরে না অধিকাংশ মালিক। বাধ্য হয়েই শ্রমিকদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ পেশা পরিবর্তন করেছে। শ্রমিকদের রক্ষা করার জন্য গতবছরের লকডাউন থেকে আমরা সরকারের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি। এই লকডাউনেও গত ১৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী বরাবরও স্মারকলিপি দিয়েছি। এখনো সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া আমরা পাইনি।
ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক বলেন, আমাদের তথ্য অনুয়ায়ী ৪০ লক্ষ নির্মাণ শ্রমিকের মধ্যে মাত্র দুই থেকে তিন শতাংশ শ্রমিক বিভিন্ন সহায়তা পেয়েছে। জীবনের তাগিদে ধানকাটাসহ বিভিন্ন কৃষিকাজে মৌসুমি শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে গিয়েছে অনেকে। আবার এখনকার পরিস্থিতিতে নির্মাণসামগ্রী আনা-নেওয়া কঠিন হওয়ায় অনেক কাজ আটকে আছে। আমাদের দাবি হচ্ছে পরবর্তী বাজেটে নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য রেশনিং, পেনশন স্কীমসহ পেশাগত নিরাপত্তার বিষয়ে একটা থোক বরাদ্দ রাখা হোক।
বাংলাদেশ হোটেল এন্ড ট্যুরিজম ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের আহ্ববায়ক রাশেদুর রহমান বলেন, করোনা সংকটে এই খাতে পেশা পরিবর্তনের ঘটনা নেই বললেই চলে। বরং গতবছর লকডাউন তুলে দেওয়ার পর অন্যান্য খাতের অনেক শ্রমিক পর্যটনে কাজ শুরু করেছেন। এই খাতকে এখনো স্বতন্ত্র খাত হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এরা কর্মক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নও করতে পারে না। আমরা সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তার আবেদন করেছি কিন্তু তা পাব কীনা জানি না।