সম্প্রতি জাতীয় পার্টির (জাপা) শীর্ষ নেতাদের ধারালো কথাবার্তা গণমাধ্যমে আসছে। এ অবস্থা ছয় মাস আগেও দেখা যায়নি। বলতে গেলে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর এই প্রথম দলটির নেতারা এ ভাষায় কথা বলছেন। ফলে সরকারি দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির কী হয়েছে—এ বিষয়ে রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আগ্রহ বাড়ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, আমন্ত্রণ পেয়েও জাতীয় পার্টির নেতারা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে এখন পর্যন্ত যোগ দেননি। ১০ দিনের এ অনুষ্ঠান ২৬ মার্চ পর্যন্ত চলবে। জাপার শীর্ষস্থানীয় একাধিক নেতা এই অবস্থানের ব্যাখ্যায় বলেছেন, এই অনুষ্ঠানে গেলে সরকারের বিরুদ্ধে তাঁদের নেওয়া সাম্প্রতিক অবস্থান খেলো মনে হতে পারে।
১৩ মার্চ জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের বনানীর কার্যালয়ে দলীয় এক সভায় বলেছেন, ‘জাতীয় পার্টি কোনো জোটে নেই। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের সঙ্গেও আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই। বর্তমানে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে চায় না, জাতীয় পার্টিও আওয়ামী লীগকে চায় না।’
আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলেমিশেই রাজনীতিতে আছে জাতীয় পার্টি। ২০১৪ সালের ‘একতরফা’ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গী ছিল জাতীয় পার্টি। মহাজোটের শরিক হয়ে দলটি একসঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলে ছিল। আবার ২০১৮ সালের ‘বিতর্কিত’ নির্বাচনও একসঙ্গে করেছে দল দুটি। সমঝোতায় সংসদে প্রধান বিরোধী দলও হয়ে যায় জাতীয় পার্টি।
কিন্তু কিছুদিন ধরে জাতীয় পার্টির প্রধান নেতা একটি কথা বারবার বলছেন। তা হলো, সাংবিধানিকভাবেই দেশে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দেশের সব ক্ষমতা এক ব্যক্তির হাতে, তিনি যা বলেন, তার বাইরে কিছু হয় না। আইনি এবং সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এই একনায়কতন্ত্র ভাঙতে হবে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি নিজের ৭৩তম জন্মদিনের এক আলোচনা সভায় জি এম কাদের বলেছেন, দেশ ও জনগণের পক্ষে সব সময় কথা বলতে হবে, এ জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত জাতীয় পার্টি। তিনি অভিযোগ করেন, সরকারি দল না করলে এখন কেউ চাকরি পায় না, ব্যবসা করতে পারে না। দেশের সব ক্ষমতাই এক ব্যক্তির হাতে। এটাকে গণতন্ত্র বলা যায় না।
জাতীয় পার্টির সাম্প্রতিক এসব বক্তব্য পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, বেশ জোরের সঙ্গেই সরকারের সমালোচনা করছেন তাঁরা। এসব বক্তব্য সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আকারেও গণমাধ্যমে পাঠানো হচ্ছে। সাধারণত অভ্যন্তরীণ সভা-সমাবেশে বক্তব্য দলীয় বিজ্ঞপ্তিতে হুবহু আনা হয় না বা প্রতিক্রিয়া হতে পারে, এমন কথাগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়। এ ক্ষেত্রেও এখন ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে।
জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারণ একটাই, দল বাঁচাতে হলে সত্য কথা বলতে হবে, মানুষের পাশে থাকতে হবে। নিজস্ব রাজনীতি না থাকলে জাতীয় পার্টি পরগাছা হয়ে টিকবে না। পরগাছা সবাই কেটে ফেলে। আওয়ামী লীগও যে কেটে ফেলবে, তার লক্ষণ তো দেখছি।’
জাতীয় পার্টির নেতারা দেশের নির্বাচনব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। জি এম কাদের ১৬ ফেব্রুয়ারি বনানীর কার্যালয়ে এক সভায় বলেছেন, বর্তমান সময়ে সরকারদলীয় প্রার্থীরা নির্বাচনে অর্থ ও পেশিশক্তি ব্যবহার করে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। নির্বাচনে অবৈধ ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রশাসন বাধা দিচ্ছে না। ফলে নির্বাচনের ফলাফল একতরফা হয়ে যাচ্ছে এবং একটি দলের প্রার্থীরাই নির্বাচনে জিতে আসছেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি দলীয় আরেক সভায় জি এম কাদের শ্লেষের সঙ্গে বলেন, রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে এখন আওয়ামী লীগ সুপারপাওয়ার হয়ে গেছে।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, নির্বাচনের নামে চট্টগ্রামে কী হলো? সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও হত্যাকাণ্ডের নির্বাচন দেশবাসী চায় না। অবিলম্বে এ রকম প্রহসন ও তামাশার নির্বাচন বন্ধ করুন।
দলের আরেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদও এ যাত্রায় একসঙ্গে আছেন। জাতীয় পার্টিতে আনিস-বাবলু অলিখিত জুটি হিসেবে পরিচিত। দুজনই দলে আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ হিসেবে নেতা-কর্মীদের কাছে পরিচিত। এরশাদ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করলেও এই দুই নেতা রওশন এরশাদকে সামনে রেখে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে নেন।
হঠাৎ সরকারবিরোধী বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে জিয়াউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিরোধী দলের কাজ কী? বিরোধী দল মানেই তো শক্ত কথা বলা। আমরা উপলব্ধি করছি, একটি রাজনৈতিক দলকে জনগণের পক্ষে কথা বলতেই হবে। নইলে আমরা কী রাজনীতি করব।’
লক্ষ করলে দেখা যায়, জাতীয় পার্টির নেতারা সরকারের পাশাপাশি বিএনপির বিরুদ্ধেও কথা বলছেন। দলটির নেতারা মনে করেন, বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির পরিচয় ধরে রাখার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা বিএনপি। এ জন্য সরকারের পাশাপাশি বিএনপির বিরুদ্ধেও কথা বলছেন তাঁরা। সম্প্রতি এক মতবিনিময় সভায় জি এম কাদের বলেন, বিএনপির আপসহীন নেত্রী (খালেদা জিয়া) আপস করেই জেল থেকে বের হয়েছেন। তাঁদের আরেক নেতার (তারেক রহমান) প্রতি বিএনপির নেতা-কর্মীদেরই আস্থা নেই।
গত বছরের অক্টোবর-নভেম্বর থেকেই জাতীয় পার্টির নেতারা সরকারের ভুল-ত্রুটি নিয়ে শক্তভাবে কথা বলা শুরু করেন। এখন এর মাত্রা বাড়ছে। এসব কথাবার্তা ছাড়াও সংসদে এবং সংসদীয় কমিটিতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারের বিরোধিতা করছে জাতীয় পার্টি। তবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙার মতো কোনো আলামত এখনো দৃশ্যমান নয়।
দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ২০২৩ সালের সংসদ নির্বাচন ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো হবে না। তাই এখন থেকে দলের সব পরিকল্পনা রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং আগামী সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক হতে হবে। সে ভাবনা থেকেই জাতীয় পার্টি এই কৌশল নিয়েছে।