ইজিবাইককে রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনার পরিকল্পনা
সারাদেশে সড়ক মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে প্রায় ১৫ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) নিয়ন্ত্রণ না থাকায় দিন দিন এর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সড়ক ও মহাসড়কে বিশৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনা সৃষ্টির জন্য হাইকোর্ট এসব যান চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তারপরেও নিষিদ্ধ এ যানগুলো চলছে চোরাই বিদ্যুতের চার্জ দিয়ে। পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এসব অবৈজ্ঞানিক বাহন নিষিদ্ধে দাবি জানিয়ে আসছিল পরিবহন মালিক শ্রমিক নেতারা। অথচ নিষিদ্ধ না করে উল্টো এসব যানকে রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনার পরিকল্পনা করেছে সরকার। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ ও সড়ক নিরাপত্তায় ইজিবাইক-থ্রি-হুইলার জাতীয় অটোরিকশা রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনতে যাচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্যে সড়ক পরিবহন বিভাগে গঠিত কমিটির পেশকৃত প্রস্তাবিত সুপারিশমালা যাচাই বাছাই করে কর্মকৌশল নির্ধারণে একটি সাব কমিটি গঠন করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার বিআরটিএ’র প্রধান কার্যালয়ে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের ২৮তম সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। মন্ত্রীর এ বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবহন মালিক শ্রমিক নেতারা বলেছেন, ইজিবাইককে রেজিস্ট্রেশন দিলে সড়কে বিশৃঙ্খলা আরও বাড়বে। তাতে দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানীও বাড়বে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ ইনকিলাবকে বলেন, বহু কষ্টের পর সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সরকার গ্রামগঞ্জের মানুষের কথা চিন্তা করে ইজিবাইককে রেজিস্ট্রেশন দিলে দিতে পারে। কিন্তু সেগুলোকে কখনওই মহাসড়ক, মহানগর বা সিটি করপোরেশনে বৈধতা দেয়া যাবে না। তাহলে সড়কের বিশৃঙ্খলা আরও বাড়বে। ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ খোকন বলেন, দেশে চলমান ইজিবাইকগুলো কোনো বৈজ্ঞানিক যান নয়। দেশের তৈরী অবৈজ্ঞানিক যান বলে এগুলোর ব্রেকের সিস্টেম ভালো নয়। এ কারণে ব্রেক করলে উল্টে যায়। যেখানে সেখানে দুর্ঘটনা ঘটে। এজন্য এগুলোকে রেজিস্ট্রেশনের নামে বৈধতা দেয়া ঠিক হবে না। তিনি বলেন, রেজিস্ট্রেশন দিতে হলে সরকার ইনট্যাক (সিবিইউ) বাইক আমাদানি করুক। এগুলোকে বৈধতা দিলে সড়কের বিশৃঙ্খলা তথা দুর্ঘটনা আরও বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সারাদেশে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকের সংখ্যা কতো তার সঠিক হিসাব সরকারের কাছে নেই। ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ খোকন জানান, সাধারণত ইজিবাইক সরাসরি কেউ আমদানী করে না। খুচরা যন্ত্রাংশ (সিকেটি) আমদানী করে পরে বডি তৈরী করে রাস্তায় নামানো হয়। এজন্য এর সঠিক হিসাব কারো জানা নেই। তিনি বলেন, সারাদেশের বিভাগীয় শহর, ৬৪ জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, গ্রাম থেকে গ্রামে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে এসব যানবাহন নেই। এগুলো যারা চালায় তাদের গাড়ি বা বাইক চালানোর মতো সামান্যতমও কোনো জ্ঞান বা ধারণা নেই। সে কারণেও সারাদেশে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা। জানা গেছে, ২০০৮ সালে মধ্যস্বত্বভোগী এক শ্রেণির মানুষ রিকশায় বৈদ্যুতিক মোটর ব্যবহারের মাধ্যমে ইঞ্জিনবিহীন হালকা যানবাহন হিসেবে রাস্তায় নামায়। ধীরে ধীরে তা বাড়তে বাড়তে প্রায় ১০ লাখে পৌঁছেছে। এর সাথে যোগ হয়েছে আরও ৫ লাখ মোটরচালিত রিকশা। এই দুইয়ে মিলে সড়ক-মহাসড়কে বিশৃঙ্খলা লেগেই আছে। সারাদেশে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা, প্রাণহানী। এর আগে ঢাকার বাইরে মফস্বল শহরগুলোতে স্যালো মেশিনের ইঞ্জিন দিয়ে নসিমন, ভটভটি, চাঁন্দের গাড়ি ইত্যাদি চলাচল শুরু করে। বর্তমানে সারাদেশেই ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকে সয়লাব। ২০১২ সালের ১০ জানুয়ারি রিকশা-ভ্যান মালিক শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক বন্ধের দাবি ওঠে। ডিএমপি কমিশনারের কাছে স্মারকলিপিও প্রদান করে তারা। এতে কাজ না হওয়ায় পরিষদের মালিকানাধীন রিকশাগুলোকে ব্যাটারিচালিত রিকশায় পরিণত করার অনুমতি চেয়ে ২০১২ সালে ২৫ জানুয়ারি যোগাযোগ মন্ত্রী বরাবর আবেদন করে। রিকশা ভ্যান মালিক সংগ্রাম পরিষদের এক নেতা বলেন, সে সময় পুলিশ প্রশাসন থেকে বলা হয়েছিল, এসব গাড়ি কোথায় কোথায় তৈরি করা হয় এবং কোন কোন প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে তাদের নাম ও ঠিকানা আমাদের কাছে দিলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো। ইজিবাইক নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন শো রুমের ঠিকানাসহ একটি তালিকা ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি পুলিশ প্রশাসনের কাছে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় নি।
সারাদেশের সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনার প্রধান উপসর্গ হিসাবে সহজেই চিহ্নিত হয় এসব ইজিবাইক। এ কারণে মহাসড়কে এগুলো চলাচল নিষিদ্ধ করার জন্য পরিবহন মালিকরা সোচ্চার হয়ে ওঠে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ অপচয়ের কারণ হিসাবেও এসব যানবাহন চিহ্নিত করা হয়। ২০১৫ সালে সরকার দেশের ২২টি মহাসড়কে এসব যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করে। কিন্তু প্রশাসনের অবহেলায় মহাসড়কে এখনও দাপটের সাথে চলছে এসব যানবাহন। এরপর হাইকোর্ট এসব যান প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়। সেই নির্দেশও কার্যকর হয়নি। সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২০১৫ সালে মহাসড়কে নিষিদ্ধ ঘোষনার পর রাজধানীতে ইজিবাইকের চাপ বেড়ে যায়। মফস্বলের ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশায় ঢাকার এখন বেহাল অবস্থা। বর্তমানে ঢাকার দুই সিটিতে এর সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়ে গেছে। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ প্রশাসনের ছত্রছায়ায় টোকেন বাণিজ্যের মধ্যেমে তেজগাঁও, উত্তরা, উত্তরখান, দক্ষিণখান, বিমানবন্দর, খিলক্ষেত, বাড্ডা, গুলশান, মিরপুর, পল্লবী, খিলগাঁও, শ্যামপুর, তুরাগ, মোহাম্মদপুর, আদাবর, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, ডেমরা, মুগদা, কামরাঙ্গীরচরসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অবাধে এসব অবৈধ যান চলাচল করছে।
জানা গেছে, সারাদেশে ১৫ লাখেরও বেশি ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা চার্জের জন্য জাতীয় গ্রিড থেকে প্রতিদিন অন্তত এক হাজার থেকে ১২শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের অন্যতম প্রধান কারণ এই সব ব্যটারিচালিত যান। ইজিবাইক ও ব্যটারিচালিক রিকশার ব্যাটারি রিচার্জ করতে চুরি করা বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়। টাকা বাঁচাতে মালিকপক্ষ এ পন্থা অবলম্বন করে থাকেন। জানা গেছে, ঢাকাসহ সারাদেশেই চোরাই বিদ্যুতে ইজিবাইকের ব্যটারি রিচার্জ করার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ থেকেই ব্যবস্থা করা হয়। বিদ্যুৎ বিভাগের দুর্নীতিবাজ কতিপয় কর্মকর্তা টাকার বিনিময়ে গ্যারেজ মালিকদের এই সুযোগ করে দেন। রাজধানীর জুরাইন, মুরাদপুর, যাত্রাবাড়ী, মীরহাজিরবাগ, ডেমরা, শ্যামপুর, হাজারীবাগ, উত্তরখান, দক্ষিণখান এলাকাসহ বহু স্থানে এরকম গ্যারেজ আছে। এসব গ্যারেজের বিদ্যুতের সংযোগ অবৈধ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেইন লাইন থেকে সরাসরি সংযোগ লাগানো। ইজিবাইক মেকানিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত একটি ইজিবাইকের জন্য চার থেকে পাঁচটি ১২ ভোল্টের ব্যাটারি প্রয়োজন হয়। আর প্রতি সেট ব্যাটারি চার্জের জন্য গড়ে ৮০০ থেকে ১১০০ ওয়াট হিসেবে ৫ থেকে ৬ ইউনিট (দিনে বা রাতে কমপক্ষে ৫-৬ ঘণ্টা) বিদ্যুৎ খরচ হয়। সে হিসেবে দেশের প্রায় ১৫ লাখ ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা চার্জের জন্য জাতীয় গ্রিড থেকে প্রতিদিন অন্তত ১ হাজার থেকে ১২শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হওয়ার কথা। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৫ টাকা করে হিসাবে ধরলে সারাদেশে ১৫ লাখ ইজিবাইকের জন্য প্রতিদিন বিদ্যুতের খরচ কমপক্ষে ৫ কোটি টাকা। এ হিসাবে মানুষের ভোগান্তির কথা বাদ দিলে সরকার প্রতিদিন ইজিবাইকের কারণে ৫ কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে।
জানা গেছে, ঢাকাসহ সারাদেশে নিষিদ্ধ ইজিবাইক চলাচলের নেপথ্যে রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা ও পুলিশ। তাদের সাথে যুক্ত বিদ্যুৎ বিভাগের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ চুরি করে সাধারণ মানুষ লোডশেডিংয়ে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করলেও লাভবান হচ্ছে ইজিবাইকের মালিক, দালালচক্র, বিদ্যুতের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ক্ষমতাসীন নেতারা। ঢাকায় নিষিদ্ধ ইজিবাইক চলাচলের সুযোগ করে দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও কতিপয় দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্য। এই টাকার পরিমানও মাসে ৩০ কোটি টাকার মতো।
ভুক্তভোগিরা জানান, ঢাকার মিরপুর, সবুজবাগ, রামপুরা, তুরাগ, খিলক্ষেত, উত্তরখান, বাড্ডা এলাকায় ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশার দাপট বেশি। তবে কদমতলী, শ্যামপুর এলাকার মতো এতোটা বিশৃঙ্খল অবস্থা ডিএমপির অন্য কোনো থানায় নেই। এ প্রসঙ্গে জাতীয় রিকশা-ভ্যান শ্রমিকলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. ইনসুর আলী ইনকিলাবকে বলেন, ঢাকা মহানগরে যদি এক লাখ ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করে তবে সেগুলোতে ৪ লাখ ব্যাটারি আছে। এর মধ্যে মাসে ৪০/৫০ হাজার ব্যাটারি নষ্ট হচ্ছে। ৫০ হাজার ব্যাটারি ক্রাশ করার মতো কোনো জায়গা কিন্তু নেই। এগুলো যেখানে সেখানে ফেলা হচ্ছে। তাতে ব্যাটারির এসিড পরিবেশকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে। তিনি বলেন,ইজিবাইককে রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনার আগে এগুলোকে সংস্কার করতে হবে। সংস্কার ছাড়া এগুলোকে বৈধতা দিলে সড়কে বিশৃঙ্খলা বাড়বে। কোনোভাবেই এগুলোকে মহাসড়ক ও মহানগরে চলতে দেয়া যাবে না। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ব্যাটারিচালিত যানগুলো পরিবেশের জন্য সরাসরি ক্ষতিকর। সঠিকভাবে এগুলোর ব্যাটারি রিচার্জ করা হয় না বলে সরকারের বাজেটে একটা বিরুপ প্রভাব পড়ে। এজন্য সরকারের উচিত এগুলো বন্ধ করার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেয়া।