সকাল বেলা ই-মেইল এ সহকর্মীদের কাছ থেকে একটি লেখা পেলাম। লেখার শিরোনাম –“বাংলাদেশের সফলতম রাষ্ট্রপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রীয় খেতাব বাতিল করায় জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এর নিন্দা ও ক্ষোভ”। তখন মনে হলো শিক্ষক হিসেবে একটু গবেষণা করা দরকার। একটি নৈতিক দায়িত্ব- বিষয়টিকে সকলের কাছে স্পষ্ট করা।
মেজর জিয়া সম্পর্কে হিরু বাঙালি নামে এক বীর মুক্তিযোদ্ধা একটি বই লিখেছেন যার শিরোনাম : “যুদ্ধের ময়দান থেকে মেজর জিয়ার পলায়ন “। তিনি এমন একটি বই প্রকাশ করেছেন ১৯৯৩ সালে-যখন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ক্ষমতায়। সম্প্রতি ওই বইয়ের লেখক একটি টিভি চ্যানেলএ একটি অনুষ্ঠানে বসে মেজর জিয়া সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন- যখন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল মেজর জিয়ার “বীরউত্তম” খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
খেতাব বাতিল হতেই পারে যদি যুক্তিযুক্ত কারণ থাকে। এই তো সেদিন অক্সফোর্ড কাউন্সিল এবং লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স মায়ানমারের সাবেক নেতা সুচির খেতাব বাতিল করলো। তথ্য প্রমান থেকে আমার মনে হয়েছে মেজর জিয়ার খেতাব বাতিলের যথেষ্ট কারণ আছে।সুতরাং, সেই খেতাব বাতিলের ক্ষমতাও সরকারের আছে। আমাদের এখনকার প্রশ্ন হলো -মেজর জিয়া কি ভাবে প্রেসিডেন্ট? তিনি কি বৈধ পন্থায় প্রেসিডেন্ট নাকি স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট? তাহলে- জানা প্রয়োজন প্রেসিডেন্ট পদটি কিভাবে রাজনীতির ডিক্টোনারিতে এলো। প্রেসিডেন্ট যেহেতু একটি ইংরেজি পদ, সুতরাং এর মানে খুঁজতে নামকরা ইংলিশ ডিক্টোনারির সহায়তা নিলাম।
১৮২৮ সন থেকে মেরিয়াম-ওয়েবষ্টার ডিক্টোনারি প্রকাশ করে আসছে। সেখানে প্রেসিডেন্ট, যার বাংলা অর্থ রাষ্ট্রপতি, একটি বিশেষ্য পদ। সেই পদটির সংজ্ঞায় বলা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট মানে হলো – 1: an official chosen to preside over a meeting or assembly, 2: an appointed governor of a subordinate political unit, 3: the chief officer of an organization (such as a corporation or institution) usually entrusted with the direction and administration of its policies, 4: the presiding officer of a governmental body, 5a: an elected official serving as both chief of state and chief political executive in a republic having a presidential government, b: an elected official having the position of chief of state but usually only minimal political powers in a republic having a parliamentary government.
১৭৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন ইংল্যান্ড থেকে স্বাধীন হলো- তখন সকলে জর্জ ওয়াশিংটনকে রাজা নির্বাচন করলো।কিন্তু ওয়াশিংটন এটিকে বিপদজনক মনে করলেন। তিনি জানেন যে তিনিই একমাত্র জাতির পিতা নন। Thomas Jefferson, John Adams, Benjamin Franklin সহ আরও অনেকের অবদান আছে যুক্তরাষ্ট্র গঠনে। সুতরাং, একটি সংবিধান রচনা করা হলো। এবং ১৭৮৯ সালের ৩০ এপ্রিল যুক্তরাষ্টের প্রেসিডেন্ট হিসেবে জর্জ ওয়াশিংটনে অভিষিক্ত করা হলো। এর আগে প্রেসিডেন্ট শব্দটি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবহার করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ পদ নির্দেশ করতে। প্রেসিডেন্ট পদটি ফরাসি বিপ্লবের পর ফ্রান্স ব্যবহার করে আসছে। ১৮৪৮ সালে নেপোলিয়ান বোনাপোটে ফ্রান্সের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
আমাদের উপমহাদেশে ভারত ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারী রাজেন্দ্র প্রসাদকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হয়। এবং ইস্কান্দার মির্জা ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট। এভাবে যদি আমরা রাষ্ট্রর ইতিহাস পর্যালোচনা করি, তবে দেখা যায় প্রেসিডেন্ট একটি নির্বাচিত পদ।সুতরাং, কেউ এককভাবে নিজেকে প্রেসিডেন্ট দাবি করতে পারেন না।
আমাদের দুর্ভাগ্য হলো- স্বাধীন বাংলার দাবি ছেড়ে আমরা পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিলাম। আর সেই রাষ্ট্রে সামরিক নেতারা মীর জাফরের মত ক্ষমতা দখল করে নিজে নিজে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। সেই পাকিস্তানী চেতনার উত্তরসূরি ছিলেন সেই সময়ের মেজর জিয়া।
সেই পাকিস্তানী চেতনা থেকে মেজর জিয়া নাকি নিজেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিয়েছিলেন-যেভাবে সামরিক পূর্বসূরিরা করেছেন। তার এই কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে প্রমান করেছেন তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী ত্যাগ করলেও পাকিস্তানী ট্রেনিং তিনি ভোলেননি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রর মাইক হাতে পেয়ে জাতির সঙ্গে তিনি প্রতারণা করেছেন।
প্রতারণার পুরস্কারও সঙ্গে সঙ্গেই পেয়েছেন। নিজেকে প্রেসিডেন্ট দাবি করে ভাষণ দিয়ে বেতার কেন্দ্র থেকে একমুহূর্তের জন্য বের হতে পারেনি মেজর জিয়া।সেখানেও একটি গণ অভ্যুর্থান হয়।শোনা যায়, তিনি আবার নিজেকে সংশোধন করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা পাঠ করেন।বটে-কয়েক ঘন্টার স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট মেজর জিয়া!
যে স্বঘোষিত প্রেসিন্ডেট মাত্র একঘন্টাও নিজের পদ ধরে রাখতে পারেনি, সেই প্রেসিডেন্ট পুত্র নাকি দাবি করছেন তার বাবা ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট! যে নেতা মাত্র একটি ঘন্টা নিজের দাবিকে বাস্তবায়ন করতে পারেনি- তিনি নাকি স্বাধীনতার ঘোষক! মেজর জিয়া যেভাবে বাংলার সর্বনাশ করেছেন তার বর্ণনা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।তিনি বাঙালিকে বাংলাদেশী বানিয়ে পায়ে হাঁটার পরিবর্তে মাথা দিয়ে হাটতে বাধ্য করতে চেষ্টা করেছেন সামরিক লেবাস পরে অথবা সামরিকতন্ত্রের কারখানায় বসে। তিনি যে “হা -না” র গণতন্ত্র আবিষ্কার করেছেন- সেজন্য কি পুরস্কার দেয়া যায় তা গবেষকরা নির্ধারণ করবেন।
মেজর জিয়া ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট এর খুনিদের প্রটেকশন দিতে ইনডিমনিটি বিলে সই করেছেন- তিনি কিভাবে নিজের এই ব্যর্থতাকে অস্বীকার করবেন? তার কর্মীরা হয়তো বলবেন-ইনডিমনিটি অধ্যাদেশ মোস্তাক জারি করেছিলেন, কিন্তু সেটি বিল আকারে পাশ করেছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সাংসদরা ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল।এবং সেই বিল অনুমোদন করেছিলেন ১৯৭৯ সালের ৩ জুন স্বপদে থেকে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জিয়া( ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বিচারপতি সায়েমকে সরিয়ে প্রেসিডেন্ট হন)।এই লজ্জা-পাপ কোথায় লুকাবে; সেটা না ভেবে যখন সফলতা দাবি করা হয়, তখন আমাদের বলবার কিছু থাকে কি? প্রেসিডেন্ট একটি নির্বাচিত পদ। জাতির এই প্রজন্মের প্রশ্ন:মেজর জিয়াকে কে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছিল?